NL24 News
০৬ নভেম্বর, ২০২৪, 7:53 PM
নারী ও সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করে সংস্কারের নামে পশ্চাৎযাত্রী বাংলাদেশের
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর জনগণের মোহভঙ্গ হচ্ছে দ্রুত গতিতে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিদায় দেওয়ার পর যে আশার আলো তারা দেখেছিলেন তা দ্রুত ফ্যাকাসে হচ্ছে। উন্নয়ন লাটে তুলে মৌলবাদীদের হাতের পুতুল হয়ে উঠছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। তাই সংস্কারের নামে মৌলবাদীদের অ্যাজেন্ডাই বাস্তবায়ণের চেষ্টার ছবি ফুটে উঠছে সর্বত্র। নারী ও সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করে দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার যেন প্রতিযোগিতা চলছে। সংস্কার নিয়ে গালভরা বক্তৃতা হলেও সেই কমিশনে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে নারী ও সংখ্যালঘুদের। নারীরা জনসংখ্যার অনুপাতে পুরুষদের থেকে বেশি হলেও সংস্কারের কাজে তাদের গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করছে না বর্তমান সরকার। সংবিধানের মূল ধারার বিপরীতে গিয়ে তালেবানদের মতো বাংলাদেশেও নারীদের পর্দার আড়ালে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রও চোখে পড়ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুখের কথা ও কাজের মধ্যে কোনও মিল নেই। সকলের প্রতি সমান মনোভাবের কথা বললেও ড. ইউনূস ও তার উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যরা নারী ও সংখ্যালঘুদের বিন্দুমাত্র মর্যাদা দিতে নারাজ। তাই ৬টি সংস্কার কমিশন পূর্ণাঙ্গভাবে ঘোষিত হলেও সেখানে নারী ও সংখ্যালঘুরা ব্রাত্য। ছয়টি কমিশনের মোট সদস্য ৫০ । এর মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র এক। নারী বিষয়ক কমিটেতেই শুধু একজনকে রাখা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের কোনও স্থান হয়নি কোনও কমিশনেই। পাহাড়ি জনজাতিদেরও রাখা হয়নি কোথাও। আসলে সর্বত্রই চলছে দেশে ফের ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্খা আইএসআইয়ের সক্রিয় সহযোগিতায় বাংলাদেশেও মৌলবাদীরা শরীয়াত আইন চালু করতে সক্রিয়। উন্নয়ন লাটে তুলে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগাতে চাইছে বর্তমান সরকারের চালিকা শক্তিরা। তারা চাইছেন মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে।
সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের নারীরাই সংখ্যাগুরু। নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ণের ব্যাপক সাফল্য এসেছে গত কয়েক দশকে। বাংলাদেশের অগ্রগতির তারা সমান অংশীদার। ২০২২ সালে লিঙ্গানুপাত পাওয়া যায় ৯৮.০৪, বর্তমানে প্রতি ১০০ জন মহিলার বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৯৮ জন। বিভাগভিত্তিক লিঙ্গানুপাতে, ঢাকা বিভাগে লিঙ্গানুপাত সর্বোচ্চ (১০৩.৪০) এবং চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বনিম্ন (৯৩.৩৮)। অথচ উন্নয়নের কাজে নারীদেরই বঞ্চিত করা হচ্ছে। নারীদের ফের পর্দানশীন করার অপপ্রয়াস শুরু হয়েছে। ড. ইউনূস ভালোই জানেন, নারীদের বঞ্চিত করে কোনও জাতি কখনওই উন্নতি করতে পারে না। এটা জেনেও তার সরকার সমানে উপেক্ষা করে চলেছেন নারীশক্তিকে।
নারীদের পাশাপাশি সংখ্যালঘুরাও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার শরিক। এমনকী, গণঅভ্যুত্থানে নারী ও সংখ্যালঘুদের অবদান কিছু কম ছিলো না। তাদের আত্মত্যাগ এতোটুকু খাটো করার কোনও জায়গা নেই। অথচ নারীদের মতো সংখ্যালঘুরাও এখন সর্বত্র বঞ্চিত। তারা কিছু বললেই তাদের গায়ে বলা হচ্ছে‘ভারতের দালাল’। এমনকী, আওয়ামী লীগ আর সংখ্যালঘুদের এক বন্ধনীতে রাখার চেষ্টাও করছেন কেউকেউ। কিন্তু সংখ্যালঘুরাও কোটা বিরোধী আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সাফল্যের তারাও অংশীদার। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেই হিন্দু-সহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে হঠিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি থেকে সংখ্যালঘুরা ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন। পুলিশ ও বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ থেকেও তাদের হঠিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল ও ঘরবাড়ি আক্রান্ত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ভূমি মাফিয়ারাও দাপট দেখাচ্ছে প্রশাসনের সামনেই। সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তকরণে বাধ্য করা হচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ বা জোর করে মুসলিমদের সঙ্গে বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে বাধ্য।
১৯৮৪ সালেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য ইলিমিনিশন অব অল ফরমস অব ডিসক্রিমিনিশন অ্যাগেইনস্ট উইমেন’ বা ‘নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন সনদ’ (সিডও) অনেকটাই কার্যকর করে। বাংলাদেশ সরকার নারীবান্ধব প্রচুর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলেও, সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়নি। নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নে এই সনদ কার্যকর করতে সরকার সম্মত হলেও প্রথম থেকেই মৌলবাদীরা বিরোধিতা করে। শাহরীয়া আইন ও সুন্নাহ আইনের কথা বলে শুরু হয় নারীদের অগ্রযাত্রার বিরোধিতা। অথচ, বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিকাল ১৯ (৩) অনুযায়ী নারীকে রাষ্ট্রই সমান সুযোগের নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য। আর্টিকেল ২৮ (১) বলছে, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার কথা। আর ২৮ (২) নম্বরে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। অথচ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার খসরা তৈরির সময় থেকেই জামায়াতের দোসর হেফাচজতে ইসলামী তার বিরোধিতা করে আসছে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক তারা চায় না। ২০০৯ সাল থেকেই হেফাজতের দাবি গুচ্ছের মধ্যে রয়েছে নারীদের প্রতি বঞ্চনার ষড়যন্ত্র। নারীর অধিকার ইসলাম বিরোধী বলে বর্ণনা করে মৌলবাদীরা এখন সমস্বরে নারীদের কোনঠাসা করতে মরিয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের নীরব সমর্থনে তাই বাংলাদেশের নারী ও সংখ্যালঘুদের অগ্রগতি আজ পিছন দিকে ধাবিতা। জাতির এই পশ্চাৎমুখী যাত্রাকেই তরান্বিত করছেন ড. ইউনূস এবং তার সরকার।
লেখক : আশরাফ উদ্দিন