"খালের বিষে মরছে গ্রাম, ফুলকলির নেই কোনো লজ্জা!"
নিজস্ব সংবাদদাতা
১৮ এপ্রিল, ২০২৫, 2:03 AM

নিজস্ব সংবাদদাতা
১৮ এপ্রিল, ২০২৫, 2:03 AM

"খালের বিষে মরছে গ্রাম, ফুলকলির নেই কোনো লজ্জা!"
মোরশেদ আলম:- পটিয়া উপজেলার প্রাণ সার্জেন্ট মহি আলম খাল—যেখানে এক সময় ভোরে মাছ শিকার করতেন জেলেরা, বিকেলে শিশুরা খেলতো পানির ধারে, আর কৃষকেরা সেচের জন্য পানির উপর নির্ভর করতেন। আজ সেই খাল যেন বিষের আধার। খালের কালো পানি থেকে ছড়ায় তীব্র গন্ধ, চারপাশে শুধু কচুরিপানা আর সাদা বিষাক্ত ফেনা।
এই চিত্র বাস্তবে গিয়ে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা যখন সরেজমীনে সেখানে যাই, খালের ধারেই দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রবীণ কৃষক অসহায় কণ্ঠে বলেন, “এই খাল আছিল আমাদের জীবনের অংশ। এখন শুধু গন্ধ আর গন্ধ। ফসলও নষ্ট হয় এই পানিতে।” এলাকাবাসীর অভিযোগ, ফুলকলি নামে পরিচিত একটি বড় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা দিনের পর দিন তাদের বর্জ্য খালের পানিতে ফেলে আসছে, কোনোরকম পরিশোধন ছাড়াই।
এই প্রতিষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা শুধু চট্টগ্রামে নয়, দেশজুড়ে। কিন্তু একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হিসেবে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা উচিত নয় কি? পরিবেশ রক্ষার জন্য একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মৌলিক দায়িত্ব হলো, ইটিপি (Effluent Treatment Plant) ব্যবহার করে বর্জ্য পরিশোধন করে তবেই তা পরিবেশে নিষ্কাশন করা। কিন্তু ফুলকলি ফ্যাক্টরি তাদের শিল্পবর্জ্য সরাসরি খালে ফেলে দিচ্ছে—এটা কেবল বেআইনি নয়, এটা ভয়াবহ অপরাধ। খালের পানি পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, এতে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যা মাছ ও জলজ প্রাণী ধ্বংস করছে, কৃষিজমি বিষাক্ত করে তুলছে, এমনকি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও সরাসরি হুমকিস্বরূপ। এই ফ্যাক্টরির বর্জ্যে এমনকি চামড়া পোড়ার মতো তীব্র গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
এখানে প্রশ্ন উঠছে—এত বড় দূষণ দিনের পর দিন চললেও, কেন প্রশাসন নিরব? পটিয়া উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি—কেউ কী সত্যিই অজ্ঞাত এই পরিস্থিতি সম্পর্কে? নাকি এ এক অদৃশ্য সমঝোতা? স্থানীয়রা জানান, একাধিকবার অভিযোগ করা হলেও শুধু ‘দেখছি’ বলেই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের অভিযান, জরিমানা বা প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। কেউ কেউ বলছেন, জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’ প্রশাসনের হাতকে বেঁধে রেখেছে। এই খালের দুই ধারে অন্তত ৪-৫টি গ্রামের হাজারো মানুষ বাস করেন।
শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের রোগ, চোখে জ্বালাপোড়া—এসব সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হন, আবার কেউ কেউ বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। দোকানপাট কমে গেছে, হাটে লোকসমাগমও হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেখানে গ্রামাঞ্চলে পানির সঙ্কট বাড়ছে, সেখানে একটি খালকেই আমরা নিজের হাতে মেরে ফেলছি। ফুলকলি ফ্যাক্টরিকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইটিপি স্থাপন ও কার্যকর করার জন্য প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। খাল পরিষ্কার এবং পানির গুণমান ফিরিয়ে আনতে আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয়দের নিয়ে পরিবেশ নজরদারি কমিটি গঠন করতে হবে যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে। মিডিয়ার উচিত এই বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান চালানো এবং প্রশাসনকে জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো।
পরিশেষে: একটি জনপ্রিয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, একটি মৃতপ্রায় খাল, আর সেই খালনির্ভর হাজারো মানুষের জীবন—এই ত্রিমাত্রিক সংকটের সমাধান আজ জরুরি। ফুলকলি ফ্যাক্টরি শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, একটি ব্র্যান্ড। সেই ব্র্যান্ডের পেছনে যে সাধারণ মানুষের শ্রম, ভালোবাসা ও আস্থা জড়িত, তাদের জীবনের ভারসাম্য ধ্বংস করে দিয়ে যদি লাভ বাড়ানো হয়, তবে তা মুনাফা নয়—অপরাধ। আমরা চাই, ফুলকলি টিকে থাকুক, দেশের গর্ব হোক—কিন্তু সেটি যেন প্রকৃতি ও মানুষের জীবনবিনাশের বিনিময়ে না হয়। প্রশাসনের নীরবতা, পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তা এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের উদাসীনতা মিলে একটি প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই কলামের উদ্দেশ্য কারো বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো নয়—বরং সচেতনতা তৈরি করা, প্রশ্ন তোলা, এবং সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানো। কারণ খাল শুধু জলধারা নয়, এটি একটি জনপদের শ্বাস-প্রশ্বাস। আজ যদি আমরা তা রক্ষা না করি, কাল এর দায় ইতিহাস আমাদের ওপরই চাপাবে।