ঢাকা ১৪ জুন, ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম
আল্লামা ইমাম হায়াত নির্বাচনী সময়সূচি পরিবর্তনকে স্বাগত এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও ডিজিটাল ভোটিংয়ের দাবি জানিয়েছেন পটিয়া বিএনপির দলীয় কোন্দল চরমে, ইদ্রিস মিয়ার বক্তব্য ঘিরে আবারো এনাম অনুসারীদের বিক্ষোভ "ইদ্রিস মিয়ার বক্তব্য ঘিরে সড়কে বিক্ষোভ এনাম অনুসারীদের" দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ভারতে বিমান বিধ্বস্ত, বহু হতাহতের শঙ্কা “দলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজরা অফিস দখল করেছে” — ইদ্রিস মিয়া ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য মুসলিম দেশগুলোর ভূমি ছাড়া উচিত: মার্কিন রাষ্ট্রদূত দেশে যেসব হাসপাতালে মিলবে করোনা পরীক্ষার সুবিধা "সুন্দর ও সমৃদ্ধ পটিয়া গড়তে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা অপরিসীম"-আনোয়ারুল আলম চৌধুরী চট্টগ্রামে জুলাই শহীদ পরিবারের পাশে এনসিপি: ঈদের আনন্দে কোরবানির পশু উপহার লন্ডনে তারেকের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক হচ্ছে: ফখরুল

করিডরের নামে আরাকান আর্মির অদৃশ্য পরিকল্পনা: বাংলাদেশের জন্য এক নীরব হুমকি

#

০২ মে, ২০২৫,  8:31 PM

news image

মোরশেদ আলম, সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট :- মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সম্প্রতি করিডরের নামে যে তৎপরতা শুরু করেছে, তা নিছক কোনো মানবিক দাবি নয়। বরং এই দাবির আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের নীলনকশা, যা বাংলাদেশের জন্য এক গভীর নিরাপত্তা সংকটের বার্তা বহন করছে। করিডরের মাধ্যমে তারা কৌশলগতভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে একটি স্বাধীন যোগাযোগ ব্যবস্থার ভিত রচনা করতে চাইছে। আর এই প্রক্রিয়ায় তারা ব্যবহার করছে ভয়, দমন ও সন্ত্রাস—যার শিকার হয়ে পড়ছে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকরাও। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মি শুরুতে একটি জাতিগত অধিকার আদায়ের সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও সময়ের ব্যবধানে তারা হয়ে উঠেছে একটি সুসংগঠিত ও কার্যকর ছায়া-রাষ্ট্র। তারা এখন নিজেদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আইন চালু করে, আদালত বসায়, রাজস্ব আদায় করে, এমনকি স্থানীয় জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণও আরোপ করে। এক্ষেত্রে করিডর তাদের জন্য শুধুই একটি 'পথ' নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বীকৃতির সূচনা বিন্দু। সম্প্রতি, আরাকান আর্মির পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে রাখাইন থেকে চিন সীমান্ত পর্যন্ত একটি অবাধ যাতায়াতযোগ্য করিডর স্থাপনের, যার মধ্য দিয়ে তারা তাদের নিজস্ব বাহিনী ও সরঞ্জাম সরবরাহ চালু রাখতে পারবে। বাস্তবে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে কার্যকর রাষ্ট্র গঠনের কৌশল। এই করিডরের মাধ্যমে তারা চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডরের সুবিধাও নিতে পারবে, ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়াবে। প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশের জন্য এর তাৎপর্য কী? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে একাধিক উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে, যার মূল উৎস আরাকান আর্মির তৎপরতা। নাইক্ষ্যংছড়ি, থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি, লামা—এসব পাহাড়ি এলাকার মানুষ আতঙ্কিত। কিছুদিন পরপর খবর আসে কেউ নিখোঁজ, কাউকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, আরাকান আর্মির সদস্যরা প্রায়শই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে, বন-জঙ্গলে অবস্থান নেয়, এমনকি কোনো কোনো ঘটনায় গুলি বর্ষণও করে। শুধু মানুষ অপহরণ নয়, নদীপথেও তারা সক্রিয়। নাফ নদী, সাঙ্গু নদী কিংবা পাহাড়ি খাল দিয়ে চলাচলকারী ট্রলার, নৌকা বা পণ্যবাহী জাহাজ থামিয়ে চাঁদা আদায় করছে তারা। এর ফলে সীমান্ত এলাকার অর্থনীতি এক ধরনের অঘোষিত অবরোধের মধ্যে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে নৌপথে চলাচল কমিয়ে দিয়েছে, যার প্রভাব স্থানীয় বাজারেও পড়ছে। এসব কর্মকাণ্ড শুধু সীমান্ত এলাকা নয়, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। আরাকান আর্মির এই কার্যক্রমের পেছনে কী কৌশল রয়েছে, তা বিশ্লেষণে দেখা যায় তারা মূলত তিনটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে এগোচ্ছে—এক, রাখাইন অঞ্চলে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা; দুই, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার মতো একটি কার্যকর কাঠামো গড়ে তোলা; তিন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কৌশলগত অবস্থান তৈরি করে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা। এই প্রেক্ষাপটে, করিডরের দাবি আসলে একটি বৃহৎ ভূরাজনৈতিক দাবার চাল। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো—বিশেষ করে চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র—এই অঞ্চলে বিভিন্ন কৌশলগত উদ্যোগে সক্রিয়। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, ভারতের “অ্যাক্ট ইস্ট” নীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি—সবগুলো পরিকল্পনায় রাখাইন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ফলে আরাকান আর্মির তৎপরতা স্থানীয় হলেও এর অভিঘাত অনেক গভীর ও বহুমাত্রিক। আরাকান আর্মি হয়তো সরাসরি চীন বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ পাচ্ছে না, তবে ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সুযোগ নিচ্ছে নিঃসন্দেহে। এরই মধ্যে কিছু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, যদি আরাকান আর্মি এই করিডর বাস্তবায়নে সফল হয়, তাহলে তারা একটি 'প্রটোকল রাষ্ট্র' বা 'অঘোষিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন চাপ তৈরি করবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই পরিস্থিতি আরও জটিল। কারণ, ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকটের পর দেশটি শরণার্থী বোঝা বহন করছে। এখন যদি সীমান্তে সহিংসতা বাড়ে এবং রাখাইন অঞ্চল থেকে নতুন করে শরণার্থী ঢল নামে, তাহলে বাংলাদেশে মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে। পাশাপাশি, সীমান্তে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়লে তা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য করণীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। যেকোনো অনুপ্রবেশ বা অপহরণ ঘটনা ঘটলেই দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রেখে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তৃতীয়ত, কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশকে বোঝাতে হবে, সীমান্ত নিরাপত্তা শুধু বাংলাদেশের একক দায়িত্ব নয়—এটি দ্বিপাক্ষিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করতে হবে। সর্বোপরি, এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিক মহলের সামনে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। জাতিসংঘ, ওআইসি, আসিয়ান কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে আরাকান আর্মির কর্মকাণ্ডের ভয়াবহতা তুলে ধরলে, বিশ্বসম্প্রদায়ের চাপের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে দায়বদ্ধ করা সহজ হবে। একইসঙ্গে, আরাকান আর্মির পৃষ্ঠপোষকতা বা সহযোগিতা পেলে যে কোন দেশ তাদের আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, সেই বার্তাও ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। করিডরের নামে আরাকান আর্মি আসলে যে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এগোচ্ছে, সে বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। তাদের তৎপরতা শুধু সীমান্তে থেমে নেই—তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলছে। বাংলাদেশকে এখনই কৌশলগতভাবে সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ এই নীরব আগ্রাসন যদি সময়মতো প্রতিহত না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তা বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে, যার দায় নিতে হবে গোটা জাতিকে।

logo

প্রধান সম্পাদক : হেফাজুল করিম রকিব

সম্পাদক : নূরুন্নবী আলী