পাহাড়চূড়ায় সাড়ে ৩০০ বছরের মসজিদ
০১ এপ্রিল, ২০২৩, 4:56 PM

NL24 News
০১ এপ্রিল, ২০২৩, 4:56 PM

পাহাড়চূড়ায় সাড়ে ৩০০ বছরের মসজিদ
চট্টগ্রাম অফিস
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক স্থান আন্দরকিল্লা। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মোঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের ইতিহাস। এ কিল্লা বা কেল্লায় ছিল মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খাঁ’র ছেলে এ কিল্লার অন্দরে বা ভেতর প্রবেশ করলে এটির নাম হয়ে যায় ‘আন্দরকিল্লা’।
চট্টগ্রাম বিজয়ের ইতিহাস ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন শায়েস্তা খাঁ। যার নাম রাখা হয় ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ’।
কথিত আছে, ১৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদের কাছাকাছি পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি টিলার ওপর আরো একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন চট্টগ্রামের তৎকালীন আরেক শাসনকর্তা ইয়াসিন খাঁ। নির্মাণের পর মসজিদটিতে ‘কদম-রসূল’ রাখলে সর্বসাধারণের কাছে গুরুত্ব পেয়ে যায় মসজিদটি। ফলে লোকশূন্য হয়ে পড়ে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ।
১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদকে গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা মসজিদটির গম্বুজ ও কয়েকটি পিলার ভেঙে ফেলে। ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯৪ বছর এখানে কোনো ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে দেয়নি তারা। পরবর্তীতে এর প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন তৎকালীন বৃটিশ রাজ্যের অধীনস্ত রাজস্ব কর্মকর্তা খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান। তার আন্দোলনের মুখে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি পুনরায় মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত হয়।
নির্মাণের পর থেকেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হয়ে উঠে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। এ মসজিদের ইমাম-খতিব নিযুক্ত হতেন পবিত্র মদিনার আওলাদে রাসুলরা। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে মসজিদটি। প্রতি জুমায় চট্টগ্রাম শহরসহ আশপাশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসল্লিরাও নামাজ আদায় করতে আসতেন এখানে। এছাড়াও পবিত্র রমজানের শেষ জুমায় হতো কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সমাগম।
প্রায় সাড়ে ৩শ’ বছরের পুরোনো আন্দরকিল্লার এ মসজিদ কালের সাক্ষী। মোঘল স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী তৈরি করা মসজিদটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে। ছোট্ট একটি পাহাড়ের ওপর এটির অবস্থান। মূল নকশা অনুযায়ী এটি ১৬ মিটার দীর্ঘ, ৬.৯ মিটার প্রস্থ এবং প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২.২ মিটার পুরু। চারটির মধ্যে পশ্চিমের দেয়ালটি পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি পাথরের। মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ ও দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা আবৃত এর ছাদ। পূর্বে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে রয়েছে মোট পাঁচটি প্রবেশদ্বার।
নির্মাণ কৌশলগত দিক থেকে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের প্রায় প্রতিচ্ছবি হওয়ায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্য বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার জন্ম দেয় এ মসজিদ। দিল্লির সেই মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করায় এটিকে ‘জামে সঙ্গীন’ (পাথরের মসজিদ) বলা হয়ে থাকে।
শুধু স্থাপত্য নিদর্শনেই নয়, শৈল্পিকদিক থেকেও আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য। কারণ চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপ শিলালিপি ভিত্তিক যেসব স্থাপনা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এ মসজিদের শিলালিপি অন্যতম। মসজিদের মূল ইমারতের প্রবেশপথে কালো পাথরের গায়ে খোদাই করা সাদা অক্ষরে লিখা ফার্সি ভাষাটির বাংলা অর্থ- ‘হে জ্ঞানী, তুমি জগতবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি (১৭৬৬ সাল)।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির দেয়া তথ্যমতে, প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মুসল্লির সমাগম হয় আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে। জুমার দিন তা বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজারে। বর্তমানে মসজিদটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সাল থেকে এ মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন আওলাদে রাসূল (সা.) মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল মাদানী।
জানা যায়, খতিবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০১ সাল থেকে প্রতি রমজানে এ মসজিদে ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন সুবিশাল ইফতারের আয়োজন করা হয়। করোনা পরিস্থিতিতে দুই রমজানে তা বন্ধ থাকলেও গত বছর থেকে পুনরায় চালু করা হয়েছে। মসজিদের খোলা বারান্দায় একাধিক সারিতে রমজানের প্রথম দিন থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিদিন অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ এ মসজিদে একসঙ্গে ইফতার করেন। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় তিন থেকে চার হাজারে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাঈনুল ইসলাম বলেন, আমরা ছোটকাল থেকে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে নামাজ আদায় করি। অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন এখানে। পূর্বপুরুষদের কাছে এ মসজিদের ইতিহাস শুনেছি। মোঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের ইতিহাস ধরে রাখতে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। যা এখনো সাক্ষী হয়ে আন্দরকিল্লার বুকে স্থান করে রয়েছে।