আত্মহত্যা বা আত্মহনন একটি সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান নয়
২১ অক্টোবর, ২০২৫, 4:49 PM

NL24 News
২১ অক্টোবর, ২০২৫, 4:49 PM

আত্মহত্যা বা আত্মহনন একটি সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান নয়
যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে একজন ক্লিনিক্যাল স্টাফ (ব্যাংক) হিসাবে আমাকে প্রতিনিয়ত ট্রেনিং করতে হয়। অদ্য হেলথ কেয়ার সার্ভিসে আত্মহত্যা (সুইসাইড) মানসিক স্বাস্থ্য এ সম্পর্কিত একটি awareness ট্রেনিং আমাকে আত্মহত্যার কারণ এবং এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যে যে সমস্ত পরিষেবা রয়েছে তা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা দিয়েছে। তাৎক্ষণিক বাংলাদেশের মানসিক রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা সচেতনতার চিত্র আমার চোখে ভেসে উঠে। বাংলাদেশের ডাটাবেজ, চিত্র কেমন সেটা জানার জন্য আমার মধ্যে একটা কৌতূহল কাজ করছে। তাৎক্ষণিক বাংলাদেশের মানসিক রোগীদের চিত্র গুগলিং অতঃপর বিস্তৃত। বাংলাদেশের চিত্র আমাকে হতাশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।যদিও হতাশা থেকে মানুষ অনেক সময় আত্মহত্যার চিন্তা করে। তবে আমার মধ্যে যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে বিশ্বাস আমি সেই রাস্তা বেছে নিব না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন, যাঁদের বড় অংশ তরুণ!
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার প্রবণতা ও এর হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিয়তই সংবাদপত্রে আত্মহত্যার খবর। বাংলাদেশের চিত্র উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা আমাকে তাড়া দিচ্ছে সামাজিক সচেতনতার জন্য হলেও একটু আলোচনার।
অনার্স ডিগ্রিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজি পড়েছি। হতাশা আবেগের মতো মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো কিভাবে আমাদেরকে প্রভাবিত করে তা জানার সুযোগ হয়েছিল।কোন বিষয় সম্পর্কে পড়া, জানা এবং এই বিষয় নিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আত্মহত্যা হলো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন সমাপ্ত করার একটি প্রক্রিয়া। আত্মহত্যার চিন্তা একজন মানুষের মনের গভীরে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়। এটি কোনো একক ঘটনা নয়, বরং মানসিক চাপ, একাকীত্ব, সম্পর্কের সমস্যাগুলো কিংবা জীবনের নানা হতাশার প্রভাব থেকে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে।
মানুষের মাথায় কেন আত্মহননের চিন্তা আসে? মানুষ কেন আত্মহত্যা করতে চায়? আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাজের দায়িত্ব কি, রাষ্ট্র কি ভূমিকা পালন করতে পারে? সর্বোপরি এই ব্যাধি থেকে আমরা কিভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারি এই বিষয়ের উপরেই সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার ইচ্ছা আমার রয়েছে। বিস্তৃত আলোচনা কঠিন, কোন বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা আজকাল পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ ঢাকাইয়া বিজনেস এন্টারপ্রেনার রুবাইয়াত
তনির তৃতীয় বিয়ে নিয়ে দেশের মানুষের ঘুম হারাম। প্রশ্ন একটাই, তিনি আগে বলেছেন জামাই মারা যাওয়ার পরে আর বিয়ে করবেন না, এখন তিনি কেন বিয়ে করলেন? আমরা মুখরোচক খাবার এবং মুখরোচক গল্প বেশি পছন্দ করি। যদিও দুনোটা আমাদের জন্য প্রডাক্টিভ কিছু না।
আসুন, তাড়াহুড়া করে আত্মহত্যার উল্লেখযোগ্য কারণগুলি একটু জেনে নেই। ডিপ্রেশন, উদ্বেগ, বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক ব্যাধি আত্মহননের প্রবণতার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করে। বাবা–মায়ের বিচ্ছেদ, পারিবারিক সহিংসতা, ঘরে অনিরাপদ পরিবেশ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আত্মহত্যা নিয়ে নীরবতা, কুসংস্কার ও অপরাধবোধ কাজ করা। এছাড়াও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, অতিরিক্ত প্রত্যাশা, প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা, সামাজিক চাপ, বুলিং, অপমান, অবহেলা, একাকিত্ব, নেশা ও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ইত্যাদি উল্লেখিত বিষয়গুলো তরুণদের মনকে অস্থির করে তোলে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এই সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের তরুণরা খোলাখুলি কথা বলে না। আমরাও অভিভাবকরা জানার চেষ্টা করি না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাবা কিংবা মা সন্তানদের হত্যা করে নিজে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিও সাময়িক হতাশা কিংবা অসুবিধায় সিদ্ধান্তহীনতায় আত্মহননের মতো ভুল পথে পা বাড়ান। অপরাধবিজ্ঞানীরা নানাভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন।
আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। খেলাধুলা, সুস্থ বিনোদন চর্চাসহ নাগরিকের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের যথাযথ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। মাদক নির্মূলে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। গবেষণা ও জাতীয় পর্যায়ে আত্মহত্যা জরিপের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে প্রাথমিক সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্সদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করতে হবে।
আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার। সন্তানের সঙ্গে প্রতিদিন কিছু সময় কাটান, শুধু শুধু পড়াশোনার খবর না —সন্তানের অনুভূতি ও মানসিক অবস্থার খবর নিন। হঠাৎ করে চুপ হয়ে যাওয়া, বন্ধুবান্ধব এড়িয়ে চলা, ঘুম বা খাওয়ার পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিন। প্রয়োজন হলে দ্রুত যথাযথ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন। বুলিং বা হেনস্তা বন্ধে কঠোর হতে হবে। হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। কাউন্সেলিং সেবা চালু করুন। নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
কিশোর–তরুণদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হবে। কোনো কিছু ভিতরে চাপা রাখা যাবে না। যেকোনো সংকটে পরিবার, বন্ধু বা শিক্ষকের কাছে যান, অনুভূতি শেয়ার করুন। ব্যর্থতা মানেই জীবন শেষ নয়। আবার পিতা বলতেন, যখন কোন সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছ না, সাময়িক সময়ের জন্য সেখান থেকে বের হয়ে আসো। মনে রাখতে হবে প্রতিটি সংকট সাময়িক। h
মানসিক কষ্টে আছেন, চতুর্দিক অন্ধকার, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন- সাহায্য নেওয়া দুর্বলতা নয় বরং সাহসের পরিচয়। আপনার কোন বন্ধু নিকট আপনজন যদি আত্মহত্যার ইঙ্গিত দেয়, অবহেলা করবেন না। তাকে গুরুত্ব দিন, তার সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন ও সাহায্যের পথে নিয়ে যান। আত্মহত্যাকে লজ্জা অপরাধ বা দুর্বলতা না ভেবে প্রতিরোধযোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে।
খুবই গুরুত্ব সহকারে আমাদের নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নিজেদের সচেতন হতে হবে। সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, ঘুম, প্রয়োজনমতো বিশ্রাম, সুশৃঙ্খলা পূর্ণ জীবনযাপন—যেকোনো ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক।
পরিশেষে, আত্মহত্যা কখনো সমস্যার সমাধান নয়। তাই এ বিষয়টি নিয়ে জানতে হবে, বুঝতে হবে, জানাতে হবে, সচেতন হতে হবে। পৃথিবীর সব ধর্মেরই বিধান হলো—আত্মহত্যা মহাপাপ। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে-কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব, এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত ২৯-৩০)।