NL24 News
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, 6:25 PM
জামায়াতের সীমান্ত হাট বন্ধের চেষ্টায় আতঙ্কিত সাধারণ গ্রামীণ মানুষ
জাকারিয়া হাসান : অন্ধ ভারত বিরোধিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকেই বিপাকে ফেলতে চাইছে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী। মুখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতার কথা বললেও তাদের কার্যকলাপে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে দেশের অর্থনীতির। অথচ অর্থনীতির হাল ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকার একগুচ্ছ পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। কিন্তু জামায়াত নেতারা পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। সম্প্রতি কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার বালিয়ামারী সীমান্তে অবস্থিত সীমান্ত হাট বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তারই একটা উদাহরণ। গ্রামবাসীরা আর্থিকভাবে লাভবান হলেও স্থানীয় জামায়াত নেতা চিঠি দিয়ে সেই হাট বন্ধের দাবি তুলেছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অবশ্য এই দাবির বিরোধিতা করে বর্ডার হাট পুনরায় খোলার দাবি তুলেছে। সরকারের প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে নিজেদের জাহির করতে গিয়ে জামায়াত যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে তাতে করে গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংস হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
সম্প্রতি সীমান্ত হাট বন্ধ করার চেষ্টা শুরু হয়েছে জামায়াতের তরফে। ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে উভয় দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে গড়ে ওঠে বর্ডার হাট বা সীমান্ত হাট। সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন উভয় পারের ক্রেতা ও বিক্রেতারা মিলিত হন নিজেদের স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য নিয়ে। সীমান্ত হাট গুলি সবই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। দুপারেই সীমান্তরক্ষীদের কড়া পাহাড়া রয়েছে। উভয় দেশের গোয়েন্দারা সজাগ দৃষ্টি রাখেন হাটে আসা মানুষদের ওপর। সীমান্ত পার হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। প্রতিটি পণ্যেরও নজরদারি চালানো হয় সেখানে। শুধু বেচেকেনাই নয়, উভয় পারের মানুষ বিনা পাশপোর্ট-ভিসায় তাদের পরিচিত আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারেন সীমান্তের জিরো লাইনে। তাই মানুষের আবেগও জড়িয়ে রয়েছে সীমান্ত হাটে। বহু মানুষ ভীড় করেন সেখানে। বর্ডার গার্ড অফ বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতের বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্স (বিএসএফ) ছাড়াও শুল্ক কর্মকর্তাও নিয়মিত নজরদারি চালান। তাই মাদক বা অস্ত্র চোরাকারবারের কোনও সুযোগ নেই। তবু জামায়াত এই সীমান্ত হাটগুলি বন্ধ করে দিতে চায়।
কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার বালিয়ামারী ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গারো পাহাড়ের কালাইয়ের চর সীমান্তবর্তী জিরো লাইনে অবস্থিত সীমান্ত হাটটি চিরতরে বন্ধ করে দিতে চায় জামায়াত ইসলামী। চর রাজিবপুর উপজেলা জামায়াতের আমির আবুল বাশার মো.আব্দুল লতিফ কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে সীমান্ত হাট বন্ধের লিখিত আবেদন জানিয়েছেন। চর রাজিবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে তিনি জেলা প্রশাসক বরাবর এই আবেদন পাঠান। চর রাজিবপুর জামায়াতের আমির আবুল বাশার মো.আব্দুল লতিফ নিজে এই আবেদনের কথা স্বীকার করেছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকেও চিঠি প্রাপ্তির কথা সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে। চর রাজিবপুর জামায়াতের আমির আবুল বাশার মো.আব্দুল লতিফের অভিযোগ, সীমান্ত হাট দিয়ে অস্ত্র ও মাদক পাচারের সম্ভাবনা রয়েছে। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগে নেতারা পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু বিজিবি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বর্ডার হাট সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারনা আছে তারা কেউই এই অভিযোগ মানতে নারাজ। কারণ প্রতিটি সীমান্ত হাটেই উভয় দেশের কড়া নজরদারি রয়েছে। সেখানে কোনও অবৈধ কারবার অসম্ভব। তাই আজ অবধি কোনও অবৈধ কারবারের অভিযোগ ওঠেনি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরও তাই বহাল তবিয়তে চলছে বেশির ভাগ সীমান্ত হাট। কিন্তু জামায়াতের চিঠির কথা জানাজানি হতেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
গত আগস্ট মাস থেকে চর রাজিবপুর সীমান্ত হাটটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। প্রশাসনিক স্তরে শুরু হয়েছিল বর্ডার হাটটি খোলার প্রস্তুতি। এই বর্ডার হাট পুনরায় চালুর প্রক্রিয়া শুরুর খবরে রাজিবপুর ও পার্শ্ববর্তী রৌমারী উপজেলার জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দেয়। কারণ এই সীমান্ত হাট অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছিল রোজগারের উৎসস্থল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কোভিডের কারণে হাটটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছিলেন। এখন ফের চালুর খবরে তারা বেশ উৎসাহিত হয়েছিলেন। কিন্তু জামায়াতের বিরোধিতায় তাদের সেই উৎসাহ আশঙ্কায় পরিণত হয়েছে। কারণ জেলা প্রশাসন ছাড়াও চর রাজিবপুর জামায়াতের তরফে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, রংপুর বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা পুলিশ সুপারদের কাছেও আবেদন পত্রের কপি পাঠানো হয়েছে। বর্ডার হাট নিয়েও অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে জামায়াত।
স্থানীয় মানুষ প্রকাশ্যেই জামায়াত আমিরের সীমান্ত হাট নিয়ে আবেদনের বিরোধিতা করছেন। রাজিবপুর উপজেলা বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুস সবুর ফারুকী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘এ নিয়ে বণিক সমিতির সঙ্গে স্থানীয় জামায়াতের কোনও আলোচনা হয়নি। তাদের আবেদনের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ রাজিবপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বাবু মিয়া বলেছেন, ‘জামায়াতের আবেদন নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। জামায়াত নেতার হাট চালুর বিরোধিতার বিষয়টি তার ব্যক্তিগত চিন্তা।’ তারা দুজনই স্বীকার করেন হাটটি বন্ধ হলে স্থানীয় মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হবে। কারণ গ্রামীণ অর্থনীতিতে সীমান্ত হাট বেশ কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে।
জানা গিয়েছে রাজিবপুর সীমান্ত হাটে নজরদারি সবরকম অবকাঠামো রয়েছে। বিএসএফ এবং বিজিবি ছাড়াও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলিরও নিয়মিত নজরদারি রয়েছে। হাটের নির্দিষ্ট এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। স্থানীয় মানুষ উৎসবের মেজাজে কেনাকাটা করেন। এই হাটে বাংলাদেশের ৬১২ জন ও ভারতের ৩০১ জন ব্যবসায়ী তালিকাভুক্ত আছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের ২৫ জন ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রি ও ৫৮৭ জন ব্যবসায়ী পণ্য কিনতে পারেন। ভারতের ৫০জন ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রি ও ২৫১ জন ব্যবসায়ী পণ্য কিনতে পারেন। হাটে ৪০-৫০টি তালিকাভুক্ত পণ্যই শুধু কেনাবেচা হয়। অস্ত্র বা মাদক বিক্রির কোনও জায়গাই নেই বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
স্থানীয় বালিয়ামারী গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, এই হাটটির পর বাংলাদেশের ৬১২ জন ব্যবসায়ীর বাইরে ১৮০ জন শ্রমিক ও ৪০ জন মাঝি প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল আছেন আরও পাঁচ শতাধিক মানুষ। তালিকাভূক্ত ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান জানান, প্রতি হাটে একেকজন ব্যবসায়ী দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা অবধি রোজগার করতে পারেন। এই টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে। শ্রমিকদের ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা আয় হয় প্রতি হাটে। হাট বন্ধের আশঙ্কায় তারা এখন সরকারকেই দুষছেন। তাদের দাবি, সাধারণ মানুষের রুটি-রুটির স্বার্থে দ্রুত খুলতে হবে সীমান্ত হাট। এদিকে, জামায়াতের এই দাবিকে কেন্দ্র করে অন্যান্য সীমান্ত হাটেও আতঙ্কের ছায়া দেখা দিয়েছে। গ্রামবাসীদের আতঙ্ক, গ্রামীণ অর্থনীতিই ধ্বংস হতে পারে জামায়াতের এধরনের পদক্ষেপে।