কোনো বাধাই দমাতে পারেনি তাদের
০৮ মার্চ, ২০২৩, 8:05 PM

NL24 News
০৮ মার্চ, ২০২৩, 8:05 PM

কোনো বাধাই দমাতে পারেনি তাদের
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম। বড় পরিবার নিয়ে বাবার সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন। সব মিলিয়ে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন যেন ছিল প্রায়ই অধরা। আর সেই অধরা স্বপ্নকেই সত্যি করে আজ দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক ফেরদৌসী বেগম।
১৯৮৭ সালে সন্দ্বীপের মোমেনা সেকান্দর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। পরে ১৯৮৯ সালে উপজেলার সরকারি হাজী আব্দুল বাতেন কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন বেসরকারি হাসপাতাল। বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
২০২০ সালে মা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের সন্দ্বীপ উপজেলা থেকে শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সেরা পাঁচ জয়িতার একজন হয়ে সম্মাননা অর্জন করেন ফেরদৌসী বেগম।
জানতে চাইলে ফেরদৌসী বেগম বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নিয়ে এ পর্যন্ত উঠে আসা খুব একটা সহজ নয়। আমরা চার বোন ও দুই ভাই নিয়ে বাবার সংসারে ছিল আর্থিক টানাপোড়েন। এ অবস্থায় বাবার পক্ষে পড়ালেখার খরচ চালানো ছিল অনেকটাই কষ্টসাধ্য। এছাড়া তখনকার সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের জন্য ছিল না তেমন সুযোগ-সুবিধা। তবু বাবার মানসিক সহযোগিতা ও নিজে টিউশন করে পড়ালেখার খরচ চালিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি।
তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন পূরণে নিজের আপ্রাণ চেষ্টার পাশাপাশি মা-বাবার উৎসাহ ছিল বেশি। বাকি জীবন মানুষের পাশে থেকে সেবা করে যেতে চাই।
বগুড়ার মেয়ে নীতু বসাক। মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কালুরঘাট কারখানায়। দেশের শীর্ষস্থানীয় এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম নারী মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার হতে পারাটা নীতু বসাকের জন্য গর্বের বিষয়।
যদিও এতটুকু পথ পাড়ি দেওয়া নীতুর জন্য সহজ ছিল না। পরিবারে কোনো ভাই না থাকায় ছিল সামাজের নানা নেতিবাচক কথা। সেসব কথা কানে না নিয়েই সুশিক্ষা ও অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করার পাশাপাশি প্রতিশ্রুতিশীল ও অনুপ্রেরণাদায়ী এক নারী হিসেবে গড়ে উঠেছেন তিনি।
বগুড়া শহরেই নীতুর বেড়ে উঠা। বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
স্নাতক ডিগ্রি লাভের পরেই কর্পোরেট জগতে পা রাখেন নীতু। দেশের অন্যতম একটি বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে ক্যারিয়ার শুরুর পর ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন করতে থাকেন তিনি। মেইনটেন্যান্স, ডিজাইনিং ও বিভিন্ন প্রোডাকশন মেশিনারিজকে ঘিরে বাড়তে থাকে তার কাজের অভিজ্ঞতা। ফার্মাসিউটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ দীর্ঘ ছয় বছরের অভিজ্ঞতা তার চলার পথকে করে আরো গতিশীল।
২০২১ সালে ইউনিলিভারে যোগদান করেন নীতু। সেখানে প্রথমে একটি প্রোজেক্টে মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে সোপ ডিপার্টমেন্টে মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। ইউনিলিভারের সঙ্গে বছর দেড়েক এর এ পথচলায় কর্পোরেট জীবনকে আরো নতুন ও গভীরভাবে আবিষ্কার করেছেন নীতু। কর্মক্ষেত্রে নারী ক্ষমতায়ন ও বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধিতে বরাবরই তাকে সাহস ও উৎসাহ জুগিয়ে এসেছে ইউনিলিভার।
এ প্রসঙ্গে নীতু বলেন, ইউনিলিভার বাংলাদেশে যোগদানের পর থেকে দেখে আসছি এখানে নারী ম্যানেজারদের সমানভাবেই বিবেচনা করা হয়। এখানে কাজের নিরাপদ পরিবেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, এখানে নিজেকে প্রমাণে বড় একটি সুযোগ রয়েছে। একেবারে ভিন্ন পরিবেশে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোম্পানি সবসময় নারী কর্মীদের সব রকমের সহযোগিতা দিয়ে পাশে রয়েছে।
সংসারের জন্য ছেলেদের আশীর্বাদ হিসেবে দেখলেও মেয়েদের তেমনটি দেখতো না সমাজের একশ্রেণির মানুষ। এক্ষেত্রে ভাগ্যবতী নীতু। পারিবারিকভাবে কখনো বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি তাকে।
বিষয়টি তুলে ধরে নীতু বলেন, আমি সৌভাগ্যবান যে বাবা-মা আমাকে সে তিক্ত অভিজ্ঞতা পেতে দেননি। তবে আমাদের পরিবারে শুধুই তিন বোন। কোনো ভাই না থাকায় সামাজের নানা নেতিবাচক কথা আমাদের শুনতে হয়েছে। আমার বাবা-মাকে বলা হতো আমাদের পড়াশোনায় যেন তারা অর্থ খরচ না করেন- কারণ ভাই না থাকায় বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে কে দেখবে এমনটাই বলতেন তারা।
তিনি বলেন, আমার এ অর্জনে বাবা, মা ও বোনদের সবারই অবদান রয়েছে। বাবা পড়ালেখায় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন আর মা সবসময় মানসিকভাবে পাশে ছিলেন। পাশাপাশি বড় বোন পথ দেখিয়েছেন এবং ছোট বোন দায়িত্বশীল হতে শিখিয়েছে।
নীতু বলেন, প্রায়ই ভাবা হয়- নারীরা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোর জন্য উপযুক্ত না। নারীদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে- যাতে তারা এসব কথা কানে না দিয়ে আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী হতে শেখে। তাহলেই তারা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে পারবে।