ঢাকা ২১ অক্টোবর, ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম
ক্রিকেটে নতুন যুগের সূচনা: আবির্ভাব হলো টেস্ট টোয়েন্টি দক্ষিণ ভূর্ষি শীতলা মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাঞ্চন নাথ, সম্পাদক সুমন দেবনাথ “টাইফয়েড এখনো মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা"—সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম “টাইফয়েড এখনো মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা"—সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে উত্তেজনা: ছাত্রদল কমিটিতে ‘শিবির সংশ্লিষ্টতার' অভিযোগ পটিয়ায় টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন সফল করতে সমন্বয় সভা পটিয়ায় ভূমি অফিসে দালালবিরোধী অভিযান, এক যুবকের সাজা ডেঙ্গুতে আরও ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১০৪২ পটিয়ায় একই দিনে অজ্ঞান পার্টির প্রতারণা ও দরজা কেটে ১৫ লাখ টাকার মালামাল চুরি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে স্বর্ণালংকার- নগদ টাকা হারালেন বৃদ্ধা

কালারমারছড়ায় শিক্ষার্থীদের এতিম বানিয়ে অর্থ আত্মসাত

#

১৯ মার্চ, ২০২৩,  10:45 PM

news image

জুয়েল চৌধুরী  মহেশখালী (কক্সবাজার) 

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ০৩নং কালারমারছড়া ইউপির (৬নং ওয়ার্ড) সোনারপাড়া গ্রামে শরীয়াহ্ ইসলামীয়া এতিমখানা ও হেফজ্খানায় কাগজে-কলমে ২৪ জন এতিম দেখালেও বাস্তবে তা নেই। গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর বাবা-মাকে মৃত দেখিয়ে ভুয়া এতিম বানিয়ে লাখ-লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন একটি প্রভাবশালী চক্র।

সরজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, মহেশখালীতে বেসরকারি এতিমখানার নামে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সরকারি বরাদ্দের টাকা ও বৈদেশিক বহু সংস্থার দানকৃত অর্থ অবাদে লুটপাট হচ্ছে। মাদ্রাসা ভিত্তিক এসব এতিমখানায় কাগজে কলমে এতিম থাকলেও বাস্তবের সাথে এর মিল নেই। অধিকাংশ এতিমখানায় নামে-বেনামে সাইনবোর্ড থাকলেও এতিমদের জন্য আলাদা ঘর নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের সামনে নাম সর্বস্ব সাইনবোর্ড থাকলেও এতিম নেই। আবার অনেক মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষক মিলে এতিমখানার নামে হাফেজি পরা ছাত্রদের এতিম বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এ রকম অহরহ অভিযোগ উঠেছে দ্বীনি এসব প্রতিষ্ঠান ও নামে-বেনামে এতিমখানার বিরুদ্ধে।

গত ১৪ মার্চ (মঙ্গলবার) কালারমারছড়া ইউপির শরীয়াহ্ ইসলামীয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙ্গিয়ে একজন মুহতামিম টাকা আত্মসাতের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে অনুসন্ধানে নামে এনএল২৪ টিম।

অনুসন্ধানে নেমে দেখা যায়, কালারমারছড়া, হোয়ানক, মাতারবাড়ী, শাপলাপুর, বড় মহেশখালী, ছোট মহেশখালী, কুতুবজোম ইউনিয়ন ও পৌরসভার অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে এতিমদের তালিকায় ব্যাপক গরমিল রয়েছে। প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সবাই এতিম কিংবা হাফেজি ছাত্রদের ব্যবহার করে টাকা কামাচ্ছেন।

অভিযুক্ত শরীয়াহ্ ইসলামীয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা সোনারপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, মসজিদ ছাড়া মাদ্রাসার সব দরজায় তালা ঝুলে আছে। তবে শরীয়াহ্ ইসলামীয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে দেখা হয় ঐ প্রাতিষ্ঠানের সভাপতি শামসুল আলম ও সেক্রেটারী হেলাল উদ্দিনের সাথে। মাদ্রাসার উঠানে তাদের সাথে প্রায় ঘন্টাখানেক কথা হয়।

সভাপতি সাহেব; শুনেছি আপনার মাদ্রাসার একজন মুহতামিম এতিমের টাকা আত্মসাত করেছেন, এই  বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যিনি এতিমদের টাকা আত্মসাত করেছেন তার নাম মৌলভী নুরুল ইসলাম। তিনি এই প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক ছিলেন। সে দীর্ঘদিন যাবৎ তার ইচ্ছেমত ও মনগড়া কমিটি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি করতেন। এই অনিয়ম সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ স্বরূপ কমিটির সবাই মিলে গত দুইতিন মাস আগে তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। সে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কাউকে না জানিয়ে মাদ্রাসার গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্যাড, আসবাবপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। এসব আসবাবপত্র ব্যবহার করে সে এখনো বিভিন্ন অনিয়ম করে বেড়াচ্ছে। এই বিষয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অভিহিত করা হয়েছে।

সেক্রেটারি হেলাল উদ্দিন জানান, দীর্ঘ বছর ধরে এতিমদের জন্য দেশীয় বিভিন্ন সংস্থা ও সৌদি সংস্থা থেকে টাকা আসলেও নুরুল ইসলামের দুয়েকজন সহযোগী ছাড়া বিষয়টি কেউ জানতেন না। মাদ্রাসার অনিয়মের বিষয়টি সামনে না আসলে টাকা আত্মসাতের বিষয়টিও জানাজানি হতোনা। এতিমদের টাকা আত্মসাতের পিছনে আর কেউ আছে কিনা গভীর তদন্ত করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহযোগিতা কামনা করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান।

এতিমদের অভিভাবক ফরিদা আক্তার, হাবীবা খাতুন, হনজন আরা ও মোতাহারা বেগমে দাবি, মৌলভী নুরুল ইসলামের সাথে মহেশখালী সমাজসেবা কর্মকর্তাদের পারস্পরিক যোগসাজশে রয়েছে। না হলে ভূয়া ডকুমেন্টস দিয়ে এত টাকা তোলা সম্ভব নয়। তারা আরো জানান, কক্সবাজার কলাতলী লাইট হাউস দারুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার মুহতামিম মাওলানা মোহাম্মদ আলী ফোন না করলে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি কেউ জানত না। তিনি এতিম ময়নার মাকে ফোন করে টাকা পৌছেছে কিনা খোঁজ নিলে বিষয়টি নিয়ে বাকি অভিভাবকদের মাঝে হইচই পড়ে যায়। এরপরই বিষয়টি জানতে পারে সবাই। খবর পেয়ে তারা কক্সবাজার লাইট হাউজ মাদ্রাসায় মৌলভী নুরুল ইসলামকে ধরতে গেলে তিনি পালিয়ে যান এবং সে সময় কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিষয়টি অবগত হয় বলে জানান। পরে চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় তারা ২৪ জন এতিমের লিস্ট সংগ্রহ করেন।

সোনার পাড়া গ্রামের ৯ বছরের এক ছাত্রী বলেন, বাড়ী থেকে টাকা দেওয়ার কথা বলে তাকে কক্সবাজার নিয়ে যায়। সেখানে হুজুরের শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো বললে তার হাতে একটি চেক তুলে দেওয়া হয়। আসার সময় ঐ চেকটি নুরুল ইসলাম হুজুর জোরপূর্বক নিয়ে পেলে।  

ফোনে যোগাযোগ হলে মাওলানা নুরুল ইসলাম টাকা আত্নসাতের বিষয়টি অস্বীকার করেন। বরঞ্চ যারা টাকা উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের সন্ত্রাসী ও ডাকাত বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, তারা ডাকাতি করার জন্য জোরপূর্বক এতিমখানার পরিচালনা কমিটিতে আসতে চান। এর আগেও এলাকার কয়েকজনের সাথে রক্তারক্তি সংঘর্ষ হয়েছে। আচ্ছা হুজুর; তালিকায় থাকা অনেক শিক্ষার্থী এতিম নয়, তারপরও কেন তাদের এতিম দেখালেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, দেখেন! হক্ব আদায় করতে গিয়ে সম্পূর্ণ তথ্য সঠিক দেয়া যায় না। তাই মাঝে মাঝে মিথ্যার আশ্রয়ই নিতে হয়। ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকদের মৃত বানিয়ে কিভাবে অনুমোদন নিয়েছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তালিকায় থাকা সব শিক্ষার্থীর বাবা মৃত। আপনি চেক করে দেখেন। এ রকম অনেক প্রশ্নের জবাবে সে অপ্রাসঙ্গিক উত্তর দেয়।

এতিমদের বাবা মৃত কিনা তা জানতে স্থানীয় ৬নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আহমদুল্লাহর সাথে কথা হলে তিনি প্রতিবেদককে নিয়ে সরজমিন অনুসন্ধানে যান। এতে দেখা যায়, এতিমদের তালিকায় থাকা সারজিয়া সোলতানা উর্মি, সুমাইয়া আক্তার, কাইয়্যিমা সুলতানা শাহীন, জন্নাতুল বকেয়া, তাহসিন আক্তার, আবদুর রহমান, মো: আনিস, মো: জিসান, রেজাউল করিম, মো: সাইফুল ইসলাম, জেনিয়া হাসনাত জেমি, মো: রেজাউল করিম ও মোহাম্মদ মারুফের বাবা মৃত নয় বরং জীবিত। অথচ তালিকায় তাদের মৃত হিসেবে দেখানো হয়। তবে মারুফের বাবা আমির ইসলাম হলেন মৌলভী নুরুল ইসলামের আপন ভাই। তাকেও তালিকায় মৃত দেখানো হয়েছে। এছাড়া তালিকায় থাকা মোছাম্মৎ রুমা ও ওসমান গণি নামের দুই শিক্ষার্থীর নাম থাকলেও বাস্তবে সোনারপাড়া-নয়াপাড়া এলাকায় ঐ নামে কোন শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি। তবে সরজমিনে উপস্থিত হয়ে তালিকার ৯ জন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত এতিম হিসেবে পাওয়া যায়।


কলাতলী লাইট হাউস দারুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার মুহতামিম মৌলভী মোহাম্মদ আলী ফোনে জানান, তালিকাটি দীর্ঘ সাতআট বছর পূর্বে করা। গত ১৩ মার্চ তালিকাটি কক্সবাজার ডিসি অফিস থেকে সঠিক তদন্তের জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়। পরে সমাজসেবা মহেশখালী কার্যালয়ের সহযোগিতায় বিষয়টি সরজমিনে তদন্ত করা হয়। কিন্তু গত বুধবার আমি নিজে মোবাইল নম্বার সংগ্রহ করে এতিমদের অভিভাবকদের নাম্বারে ফোন করলে অভিভাবকেরা চেক পায়নি বলে জানান।

শরীয়াহ্ মাদ্রাসার বর্তমান মুহতামিম মাওলানা জমির উদ্দিন জানান, এতিমখানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি এলাকাবাসীর অনুদানে চলছে। সরকার কিংবা বৈদেশিক সংস্থা থেকে নিয়মিত সহযোগিতা আসলেও এতোদিন এলাকার কেউ জানতেন না। ওই এতিমদের টাকা তিনি একাই নিজ কাজে ব্যবহার করতেন। যেটা আইনের পরিপন্থী।

উপজেলা সমাজসেবা অফিসারকে ফোনে না পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে কালারমারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ জানান, বিষয়টি জানার পর আমি নিজেই লাইট হাউজ মাদ্রাসায় যায়। তবে আমি যাওয়ার খবর পেয়ে মৌলভী নুরুল ইসলাম সেখান থেকে সরে যায়। এতিমদের হক্ব ফিরিয়ে দিতে আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে আশ্বাস দেন।


অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, শরীয়াহ্ ইসলামীয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠা হয় ২০০৬ সালে। প্রতিষ্ঠার শুরুতে এতিমখানা না থাকলেও বছর চারেক পর যুক্ত করা হয় হেফজখানা ও এতিমখানা। সে সময় থেকেই প্রতিমাসে কিংবা বছরে এতিম ও মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে টাকা আসা শুরু করে। এতদিন সেই টাকা আত্মসাত করে আসছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নুরুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা।

এমনকি কিছুদিন আগে সৌদি আরবের বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর রিলিফ ওয়েলফেয়ার এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইওআরডাব্লিউও) কর্তৃক দেয়া এতিমদের নামে বরাদ্দকৃত চেক এতিমদের না দিয়ে এখনো লাপাত্তা রয়েছেন তিনি। এই ঘটনায় ১৭ মার্চ (শুক্রবার) মাদ্রাসা চত্বরে জড়ো হয়ে এলাকাবাসীদের নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে এতিমদের অভিভাবক ও বর্তমান মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি। গত ১৪/০৩/২০২৩ইং তারিখে মৌলভী নুরুল ইসলাম এলাকাবাসী কিংবা মাদ্রাসা কমিটির কাউকে না জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যবহার করে এতিমদের যে টাকা আত্মসাত করেছে, তা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও প্রতারণা। মুলত মাদ্রাসাটিতে পাশ্ববর্তী নয়াপাড়া, সোনারপাড়া ও চিকনীপাড়া গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে ভূয়া এতিম বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মাদ্রাসার মুহতামিম ও তার সহযোগীরা। মৌলভী নুরুল ইসলাম দায়িত্বে থাকাকালীন সময় থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এলাকাবাসীকে মাদ্রাসার কোনো সঠিক হিসাব দিতে পারেনি। সবসময় একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ছিল তার।

logo

প্রধান সম্পাদক : হেফাজুল করিম রকিব

সম্পাদক : নূরুন্নবী আলী