
নিজস্ব সংবাদদাতা
১৫ অক্টোবর, ২০২৩, 10:26 AM

অদৃশ্য ‘ক্ষমতার’ জোরে বহাল পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা : বিব্রত উর্ধ্বতন কর্মকতারা
ডেস্ক রিপোর্ট: চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ সব্যসাচী নাথ অনিয়মকে নিয়মে পরিনত করে দিনের পর দিন নিজের সেচ্ছাচারিতায় কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসলেও এখনো তিনি বহাল তবিয়তে। এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নানা অনিয়মের বিষয়ে একাধিকবার তদন্ত কমিটির তদন্তে সত্যতা মিললেও এখনও পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নানা অনিয়ম ও সেচ্ছাচারিতার কারনে স্বাস্থ্যসেবা ব্যহত হলেও কোন এক অদৃশ্য খুটির ছায়ায় দিনের পর দিন বহাল রয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাবরক্ষক রাজিব মজুমদারের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত চলাকালীন সময়ে তার পক্ষে সাপায় গাওয়া, তাঁকে প্রধান সহকারী করার জন্য বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সুপারিশ ও বারবার বিরক্ত করায় ‘বিব্রত’ হয়ে সব্যসাচী নাথের বিরুদ্ধে জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ ইলিয়াছ চৌধুরী একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য সূত্রে জানা গেছে, কোভিড চলাকালীন সময়ে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভূয়া বিল বানিয়ে, স্বাস্থ্য সহকারী, টিকা বিতরণকারী, গ্রাম পুলিশদের টাকা আত্মসাত ও সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা নিয়ে নয়ছয় করার তথ্য পাশ হলে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত রাজিব মজুমদারকে বদলি করা হয় লোহাগাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে তাকে ‘প্রধান সহকারী’ করতে সিভিল সার্জনকে সুপারিশ করেন সব্যসাচী নাথ। কিন্তু তার বিষয়ে গত ৯ আগস্ট পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ নানা দপ্তরে একটি চিঠি দেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াছ চৌধুরী।
আরও জানা গেছে, সিভিল সার্জনের কাছে রাজিব মজুমদারের জন্য সুপারিশ করেন সব্যসাচী নাথ। কিন্তু এর আগে রাজিবের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা এনে তাকে বদলির জন্যও সুপারিশ করেন সব্যসাচী। এছাড়াও রাজিবকে লোহাগাড়া বদলি করা সত্ত্বেও পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অফিস করতে দেখা গেছে। আর এজন্য সিভিল সার্জন রাজিবের সকল অনিয়ম উল্লেখ করে সুপারিশের বিষয়টি ‘বিব্রতকর’ বলে একটি চিঠি পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন দপ্তরে দেন। এমনকি রাজিব মজুমদারের নানা অসদাচরণের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) দপ্তর থেকেও সিভিল সার্জনকে অনুরোধ জানানো হয়।
এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, মহামারী করোনা চলাকালীন সময়ে রাজিবের বিরুদ্ধে টেন্ডার কার্যক্রমে অনিয়ম করায় তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করেন। তবে এই ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি করা হলেও কোন এক অদৃশ্য কারনে এখনও মেলেনি তদন্ত প্রতিবেদন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তার জোগসাজসে অনিয়ম সংগঠিত হওয়ায় হিসাব রক্ষক রাজিবকে বাঁচাতে শুরু থেকে তৎপর ডাঃ সব্যসাচী নাথ। এছাড়াও এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করোনা ভ্যাক্সিন বিক্রি, টিকা বিতরণকারী সেচ্ছাসেবীদের টাকা আত্মসাৎ, বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের টাকা নিজের পকেটে পুরানো সহ তার অনিয়ম সেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে একাধিক নিউজ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকায়।
চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন পটিয়া পৌর মেয়র আইয়ুব বাবুল। এতে তিনি উল্লেখ করেন, দুই লাখ বাসিন্দার পটিয়া পৌরসভায় একটি কেন্দ্রেই কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই কেন্দ্র বৃদ্ধির কথা জানালে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তা কর্ণপাত করেননি। পরে উচ্চ মহলের সঙ্গে আলাপ করে পৌরসভায় নয়টি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্ট রুল না মেনে পৌরসভার সম্মান ক্ষুন্ন করেছেন সব্যসাচী। এছাড়া কোভিড-১৯ টিকার দায়িত্ব পালনকারী স্বেচ্ছাসেবী, গ্রাম পুলিশ, আনসারদের জন্য আসা সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, করোনার ঝুঁকিতে থাকা বাবুলের পরিবারের সদস্যদের টিকা দিতে বললে বিভিন্ন অজুহাতে বাবুল ও তার পরিবারকে করোনার টিকা দেননি সব্যসাচী। পরে লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি টিকা নিয়েছেন। এছাড়া বাবুলের একমাত্র ছেলে আতিক শাহরিয়ার মাহির ১৮ বছর পূর্ণ হলেও বারবার অনুরোধের পরও ছেলের টিকার ব্যবস্থা করেননি সব্যসাচী। পরিশেষে বাবুলের একমাত্র ছেলে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ডা. সেখ ফজলে রাব্বিকে সভাপতি, নোয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) স্বাস্থ্য এর দপ্তরকে সদস্য করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট গত এক মাস আগেই জমা দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির সভাপতি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ডাঃ সব্যসাচী নাথের আচরণে তারা খুবই বিব্রত। হিসাব রক্ষক রাজিবের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে স্বাস্থ্য বিভাগকে এই বিষয়ে জানানো হবে। এছাড়াও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সব্যসাচী নাথের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখুন তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। আমরা এই প্রতিবেদনের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহতি করেছি। কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিবেন।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনিয়ম নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় ৩ অক্টোবর ডা. সব্যসাচী নাথের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সত্যতা মিললেও এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।