নিজস্ব সংবাদদাতা
২৭ জুন, ২০২৪, 5:07 PM
রাসেলস ভাইপার নিয়ে ফেসবুকে-অনলাইনে যে ধরনের গুজব
মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইনগুলোতে গত ১৯ জুন যে সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ করা হয়, তার অনেকগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়নি। সাপের ছবি, সাপের বিবরণ ও পুরনো ঘটনা এখনকার বলে চালানোর গুজব চিহ্নিত হয়েছে। ‘রিউমর স্ক্যানার’ টিমের অনুসন্ধানে রাসেলস ভাইপার নিয়ে এখন পর্যন্ত আলোচিত ১০টি গুজব বের হয়ে এসেছে।
ফেসবুকে দেওয়া কার্ডে একটি সাপের ছবি ব্যবহার করে ‘ভোলায় তজুমদ্দিনে খেলার মাঠে রাসেলস ভাইপার পিটিয়ে মারলো এলাকাবাসী’ শিরোনামে একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করা হয়। ফ্যাক্টচেকে জানা যায়, ভোলার তজুমদ্দিনে তীব্র বিষধর রাসেলস ভাইপার সাপ পাওয়ার দাবির খবরে একাধিক গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিটি রাসেলস ভাইপার সাপের নয়, বরং এটি মৃদু বিষধর নোনাবোড়া বা জলবোড়া সাপের ছবি—যার কামড়ে মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই। সাপের গবেষকরা বলছেন, রাসেলস ভাইপার না চিনে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার পরিবেশের ক্ষতি করবে। বরং গণমাধ্যমে সঠিক সাপের ছবি ও তা চেনার উপায় প্রচার করা দরকার।
যশোর বা সিরাজগঞ্জে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে শিশুর মৃত্যুর যে ঘটনাটি অনলাইনগুলো প্রকাশ করেছে, সেই ঘটনাটি ওই এলাকার বা সাম্প্রতিক সময়েরও নয়। বরং কক্সবাজারে ২০২২ সালে সাপের আক্রমণে মারা যাওয়া শিশুর ছবি ব্যবহার করে আলোচিত ভুল দাবিগুলো প্রচার করা হচ্ছে।
এরইমধ্যে বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। এরইমধ্যে ফেসবুকে এক শিশুর ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে—চাঁদপুর জেলার তরপুরচন্ডী ইউনিয়নে ৯ বছরের এক শিশু খেলার সময় রাসেলস ভাইপার সাপের ছোবল খেয়ে মারা গেছে। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদপুর জেলার তরপুরচন্ডী ইউনিয়নে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে শিশু মৃত্যুর দাবিটি সঠিক নয়। বরং হবিগঞ্জে গত এপ্রিলে সাপের কামড়ে একটি শিশু মৃত্যুর ঘটনার ছবি ব্যবহার করে ভুল এই তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া, বোড়া বা উলুবোড়া) দেখা যাওয়ার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এবং জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ দেখে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এরইমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জননিরাপত্তা এবং জনকল্যাণ নিশ্চিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ‘রাসেলস ভাইপার’ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর ৬(১) ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত প্রাণী। ‘রাসেলস ভাইপার'’ ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সাপের বিষ থেকে অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়। সাপ মারা দণ্ডনীয় অপরাধ, সাপ মারা থেকে বিরত থাকুন।’’
কী ধরনের গুজব বেশি দেখা গেলো প্রশ্নে রিউমর স্ক্যানারের হেড অব অপারেশন সাজ্জাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেশিরভাগ প্রতিবেদনে ভুল ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি পুরনো সংবাদ এখন নতুন করে শেয়ার দেওয়ার বিষয় আছে। একটা ছবি একাধিক পত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন জায়গার ছবি দাবি করে প্রকাশ করা হয়েছে। রাসেলস ভাইপার এতই যদি বংশবিস্তার করে, তাহলে আজকের দিনে ফেসবুকে হাজার হাজার ছবি চলে আসার কথা। এখন আতঙ্ক না ছড়িয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।’
‘সাপ নিয়ে আতঙ্ক দূর করতে সবার আগে জরুরি সাপটাকে চেনা’, উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাপ না চিনে, আসলে কোথায় কোথায় দেখা যাচ্ছে তা না জেনে, ফেসবুকে পোস্ট দেখে ভাইরাল করাটা বিপজ্জনক—মানুষের জন্য, সাপের জন্যও।’ তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। মানুষকে আতঙ্কিত না হতে সচেতন করা দরকার এবং সরকার কী কী করছে জানাতে হবে। তাতে জনগণ স্বস্তিতে থাকবে।’
‘প্রথমত, চেনানো দরকার সাপটা দেখতে কেমন। এটার সঙ্গে অজগর, স্যান্ডবোয়ার মিল আছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই গায়ের গোল গোল রিংয়ের ভিন্নতা চোখে পড়বে। রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার গায়ের চাকা গোল চিহ্নগুলো আলাদা আলাদা, অজগরের চাকা গোল চিহ্নগুলো নেটের মতো, একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। চিনে রাখুন, ভয়ের কিছু নেই্। এই সাপ দৌড়ে তাড়া করে না, বাসায় এসে কামড়াবে না। আর কর্তৃপক্ষের জায়গা থেকে বৈজ্ঞানিক সার্ভে করা যেতে পারে। এই কাজগুলো হলে গুজব ছড়ানো এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে।’